আইএসে যোগ দেয়া সেই শামীমা এখন ‘অনুতপ্ত’

মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়ে ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দেয়া ব্রিটিশ-বাংলাদেশি মেয়ে শামীমা বেগম বলছেন, তিনি এজন্য বাকি জীবন গ্লানি বোধ করবেন এবং এখন তিনি সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তা করতে চান।

তিনি বলেন, তিনি তার জীবনকে মানুষের জন্য কাজে লাগাতে চান, শরণার্থী শিবিরে ‘পচে’ মরে তা অপচয় করতে চান না।

গতকাল বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সিরিয়ার এক শরণার্থী শিবির থেকে বিবিসি, বিবিসি ফাইভ লাইভ ও আইটিভিকে পৃথক সাক্ষাৎকার দেন শামীমা।

বিবিসির রিপোর্টার জশ বেকারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন শামীমা বলেন, আইএসে যোগ দেবার কথা মনে পড়লে তিনি অসুস্থ বোধ করেন, নিজের প্রতি ঘৃণা বোধ করেন এবং এখন তার প্রকৃত অনুভূতি প্রকাশ করতে পেরে তিনি স্বস্তি বোধ করছেন।


তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাকি জীবন এজন্য দুঃখ বোধ করবো। আপনি আমার মুখে তার ছাপ দেখতে পান বা না পান - এটা আমাকে ভেতর থেকে মেরে ফেলছে। এজন্য আমি ঘুমাতে পারি না। আইএস মানুষের জীবন নষ্ট করেছে, আমার ও আমার পরিবারের জীবন নষ্ট করেছে।’

বিবিসির রিপোর্টার তাকে প্রশ্ন করেন- আইএস তার খেলাফত কায়েম রাখতে পারেনি বলেই কি তিনি এখন তার মত পরিবর্তন করেছেন? জবাবে শামীমা বলেন, বহুদিন আগেই তার ধারণা পরিবর্তন হয়েছিল, তবে এখন তিনি তা প্রকাশ করতে পারার মতো মানসিক অবস্থায় পৌঁছেছেন।

আইটিভিকে দেয়া শামীমার সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয় ব্রিটেনের স্থানীয় সময় সকালের অনুষ্ঠান ‘গুড মর্নিং ব্র্রিটেন’এ। এতে শামীমা ব্রিটিশ জনগণ ও ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে ব্রিটেনে ফেরার সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানান।


এই সাক্ষাৎকারে শামীমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ধরা যাক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এই সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখছেন বা তার কথা পড়ছেন, তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে কী বলতে চান।

জবাবে শামীমা বলেন, ‘আমি বলতে চাই আপনি সন্ত্রাসবাদ দমনে নিশ্চয়ই হিমসিম খাচ্ছেন, আমি এ নিয়ে আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে আপনাকে বলতে পারবো এই জঙ্গিরা কিভাবে সিরিয়ার মতো জায়গায় লোকজনকে তাদের কথামত কাজ করতে বাধ্য করে। আমি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপনার লড়াইয়ে সাহায্য করতে পারবো।’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের উচিৎ আমাকে হুমকি হিসেবে গণ্য না করে বরং সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা।’

শামীমা ও তার দুই বান্ধবী যখন ব্রিটেন ছেড়ে যাচ্ছেন তখন গ্যাটউইক এয়ারপোর্টের সিসিটিভিতে রেকর্ড করা ফুটেজ প্রকাশ করে পুলিশ। ছবি:বিবিসি

শামিমা ২০১৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে আইএসে যোগ দিতে লন্ডন থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন সিরিয়ায়। তিনি তুরস্ক হয়ে সিরিয়ার রাকায় পৌঁছান ও সেখানে ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়া নেদারল্যান্ডসের এক যোদ্ধাকে বিয়ে করেন। এই ব্যক্তিই তার তিন সন্তানের পিতা।

আইএসের খেলাফতের পতনের পর ধরা পড়েন। তবে তার যুক্তরাজ্যে ফেরার পথ হয়েছে বন্ধ। আইনি লড়াইয়েও সেই পথ খোলেনি। ২২ বছর বয়সী শামিমা এখন সিরিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে রয়েছেন। শামিমার বিরুদ্ধে আইএসের হয়ে সক্রিয় তৎপরতা চালানোর অভিযোগ রয়েছে; যদিও তিনি তা অস্বীকার করে আসছেন।

২০১৯ সালে তাকে সিরিয়ার এক শরণার্থী শিবিরে নয় মাসের গর্ভবতী অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে জন্ম নেয়া তার সন্তান পরে নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এর আগেও তিনি তার আরো দুটি সন্তান হারিয়েছেন। শামীমা বেগমকে খুঁজে পাওয়ার পর তৎকালীন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী) সাজিদ জাভিদ তার নাগরিকত্ব বাতিল করেন।

শামিমার স্বামী ইয়াগো রেইডিকও এখন রয়েছেন সিরিয়ার কুর্দিনিয়ন্ত্রিত একটি বন্দিশিবিরে। স্বামীর দেশ নেদারল্যান্ডসও শামিমাকে নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

২০২০ সালে সিরিয়ার এক ক্যাম্পে তোলা শামীমা বেগমের ছবি

২২ বছর বয়সী শামীমা বেগম আইটিভির গুড মর্নিং ব্রিটেন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন একেবারে পশ্চিমা ধাঁচের খোলামেলা পোশাক পরে, যে ধরণের পোশাকে তাকে আগে কখনো দেয়া যায়নি। তার পরনে ছিল ধূসর রঙের স্লিভলেস ভি কাট ভেস্ট, মাথায় বেজ বল হ্যাট ও নখে গোলাপি নেইল পলিশ।

প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে শামীমা তার পালিয়ে গিয়ে আইএসে যোগ দেয়া, সেখানে তার জীবন ও কেন এখন তিনি আবার ব্রিটেনে ফিরে আসতে চান তা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন।

শামীমার এই সাক্ষাৎকার নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন তীব্র আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই অভিযোগ করছেন, শামীমা আসলে এখন ব্রিটেনে ফিরে আসার জন্য ও মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই ইচ্ছে করেই খোলামেলা পশ্চিমা পোশাকে এই টিভি অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

সাক্ষাৎকারে শামীমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি বোরকা ছেড়ে যে এখন আবার পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরেছেন, তা এরকম একটা উদ্দেশ্যে কী না? জবাবে শামীমা বলেন, তিনি হিজাব পরা ছেড়ে দিয়েছেন প্রায় এক বছরেরও বেশি আগে, তিনি নিজেই হিজাব খুলে ফেলেছেন। কারণ তার মনে হচ্ছিল হিজাবের কারণে তিনি একটা গন্ডির মধ্যে বাঁধা পড়ে যাচ্ছেন। তিনি যদি হিজাব না পরেন তাতেই তিনি বেশি স্বস্তি বোধ করেন।

তিনি আরো বলেন, হিজাব না পরা অবস্থায় লোকজনকে তার ছবি তুলতে দেয়ার অনেক সুযোগ তার আগেও ছিল।

তার বেশ-ভূষা ও চেহারায় এই নাটকীয় পরিবর্তন মানুষের মন জয় করার জন্য নয় বলে তিনি দাবি করেন।

সাক্ষাৎকারে আইটিভির উপস্থাপক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইসলামিক স্টেটের আত্মঘাতী হামলাকারী জঙ্গিদের গায়ে তিনি বোমার বেল্ট সেলাই করে বেঁধে দিয়েছেন এমন অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে তিনি কী বলবেন।

উত্তরে শামীমা বেগম বলেন, এরকম কাজ তিনি কখনো করেননি। ব্রিটিশ সরকার যদি সত্যি মনে করে যে তিনি এরকম কাজ করেছেন, তাহলে তাকে ব্রিটেনে ফিরিয়ে এনে কেন তারা বিচারের মুখোমুখি করছে না। তিনি দাবি করেন, ব্রিটিশ সরকার আসল সত্য জানে, তিনি কখনোই খারাপ কিছু করেন নি। তিনি একমাত্র কোনো অপরাধ যদি করে থাকেন, সেটি হচ্ছে আইএসে যোগ দেয়ার মতো বোকামি করা।

এজন্যে ব্রিটিশ জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি ব্রিটিশ জনগণের পক্ষে আমাকে ক্ষমা করা কঠিন, কারণ তারা ইসলামিক স্টেটের হামলার ভয়ে দিন কাটিয়েছেন, অনেকে ইসলামিক স্টেটের কারণে তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। আমি জানি তাদের পক্ষে আমাকে ক্ষমা করা কঠিন। তারপরও আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বলতে পারি, আমি যদি এখানে আসার কারণে কাউকে আহত করে থাকি, তার জন্য আমি সত্যি সত্যি দুঃখিত।’

শামীমাকে সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি বংশগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক, কাজেই তিনি কেন বাংলাদেশে যাচ্ছেন না? এর জবাবে শামীমা  বলেন, তিনি জীবনে কখনো বাংলাদেশে যাননি, বাংলাদেশি নাগরিকত্বের কোনো অধিকার তার নেই। আর বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, তাকে সেখানে যেতে দেয়া হবে না ও গেলে তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।

তিনি প্রশ্ন করেন, ব্রিটেনের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যারা মৃত্যুদণ্ডে বিশ্বাস করে না, তারা কীভাবে আশা করে যে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশে যাবেন। 

শামিমা নতুন ইচ্ছার কথা জানালেও তার নাগরিকত্ব যুক্তরাজ্য বাতিল করেছে এবং তা ফিরিয়ে দেয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ।

শামিমার নাগরিকত্ব বাতিলের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সাজিদ বলেন, যুক্তরাজ্যের জনগণের ‘নিরাপত্তার স্বার্থেই’ ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এবং তা ঠিকই আছে।

তবে মানবাধিকার সংস্থা লিবার্টি শামীমার বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য সরকারের আচরণে ক্ষোভ জানিয়ে বলেছে, তার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার হুজুগের বশে উড়িয়ে দেয়া কোনো গণতান্ত্রিক সরকারেরর কাজ নয়। -বিবিসি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //